হিন্দু পুরাণে যেমন কামদেব, ঠিক তেমনই গ্রিক বা ল্যাটিন শাস্ত্রে প্রেমের দেবতার নাম কিউপিড। ইংরেজি Cupid শব্দটি এসেছে ল্যাটিন ভাষার Cupido শব্দ থেকে। যার অর্থ ‘‘কাম”। যেমনটা ‘‘কামদেব’’। আর তাই কিউপিড হল রোমান পুরাণের কামদেবতা। তো এই প্রেমের দেবতা কিউপিডের বাবা হলেন যুদ্ধের দেবতা মার্স এবং মা হলে প্রেমের দেবী ভিনাস। তবে প্রেমের দেবতা কিউপিডকে নিয়ে কিছু ধোঁয়াশাও রয়েছে। যেমন গ্রিক পুরাণে তাঁর নাম ইরস।
আবার এই ইরসকে রোমানদের নানা গাল-গল্পে ছোট্ট সুন্দর দুটি ডানার অধিকারি তরুণ হিসাবে দেখান হয়েছে। হেলেনীয় সময়ে তাঁকে নিটোল স্বাস্থ্যের অধিকারী ডানাযুক্ত বালকের চেহারায় দেখতে পাওয়া যায়। অনেকের ধারনা, ইরস বা কিউপিডের মূর্তিতে পরে তীর ও ধনুক ধরিয়ে দেওয়া হয়। যা কিউপিডের শক্তির প্রতীক। একজন দেবতা বা মানুষ যে কেউ তাঁর তীরের আঘাতপ্রাপ্ত হলে অপ্রতিরোদ্ধ কামের বশবর্তী হবে। আর্থাৎ আমাদের কামদেবের মতোই ব্যাপার আর কী!
কামদেবের পুষ্পবাণ থেকে রক্ষা পাওয়ার ক্ষমতা কারোরই নেই। স্বয়ং শিবও কামদেবের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়েছিলেন। তাঁরও ধ্যানভঙ্গ হয়েছিল। যে কারণে রেগে গিয়ে কামদেবকে তিনি তাঁর তৃতীয়নয়নের আগুন দিয়ে ভস্ম করে ফেলেন। পরে রতি এসে অনেক কেঁদে-কেটে মহাদেবের কাছ থেকে তাঁর স্বামী কামদেবকে ফিরে পেয়েছিলেন। সে অন্য কাহিনী। পরে একদিন এনিয়ে আলোচনা করা যাবে। আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় রোমানদের কামদেব, যাঁর নাম কিউপিড বা ইরস। যাঁকে কিনা গোটা পৃথিবী এই ভ্যালান্টাইন ডে’র আগে স্মরণ করে।
কিউপিড এবং সাইকির গল্প (roman mythology cupid)
কিউপিড সম্পর্কে সবচেয়ে বিখ্যাত গল্পগুলির মধ্যে একটি হল সাইকির প্রতি তাঁর ভালবাসা। এডিথ হ্যামিল্টনের সুপরিচিত বই ‘‘মিথলজি: টাইমলেস টেলস অফ গডস অ্যান্ড হিরো’’-সহ অনেক জায়গায় এই গল্পটি বলা হয়েছে।
গল্পটা এই রকম, কিউপিডের মা ভেনাস সাইকির দুর্দান্ত সৌন্দর্যের কারণে সাইকির প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠে। আর সেটাই স্বাভাবিক। সাধারণ মানুষ এতদিন প্রেমের দেবী ভেনাসের সৌন্দর্যে মুগ্ধ ছিল। কিন্তু সাইকির রূপ এতবেশি, সবাই ভেনাসকে ছেড়ে মানবি সাইকিকে নিয়েই আলোচনা করতে থাকে। ভেনাস প্রতিশোধ নিতে তাঁর ছেলে কিউপিডকে ডেকে পাঠালেন। কিউপিড এলে ভেনাস তাঁকে বললেন, ‘‘যে করেই হোক সাইকিকে প্রেমের জালে জড়াতে হবে। আর কাজ শেষ হলেই পৃথিবীতে ফিরে আসতে হবে।’’ ভাবুন, মা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বিকে সরাতে ছেলেকে বলছে প্রেম করতে হবে। আহা, যদি এমন সুযোগ সবাই পেত।
যাক গে হা হুতাশ করে কী হবে, যা বলছিলাম – তো কিউপিড তো এক্কেবারে মায়ের কথায় রাজি। প্রেমের দেবতাকে এক মার মার কাট কাট সুন্দরীর সঙ্গে প্রেম করতে হবে এ আবার নতুন কথা কী। সুতরাং কিউপিড বাধ্য ছেলের মতো মায়ের কথায় সাইকিকে পটাতে চলে গেল। আর এদিকে ভেনাস ভাবলেন, বেশ মজা হবে। সাইকিকে বেশ বাগে পাওয়া যাবে। কিন্তু ভেনাস ভুলে গেলেন, তাঁর এই চাল উলটোও পড়তে পারে। হলও তাই।
কিউপিড সাইকির বিয়ে (Marriage of Cupid and Psyche)
এদিকে, সাইকির আবার অন্য সমস্যা। সাইকির আরও দুই বোন আছে। তাঁরাও খুবই সুন্দর। কিন্তু সাইকির ধারে-কাছে তাঁরা আসে না। এই দুই বোনের বিয়েও হয়ে গিয়েছিল। আসলে লোকে সাইকির কাছাকাছি আসার জন্য সাইকির দুই বোনকে আগেই বিয়ে করে ফেলেছিল। কিন্তু সাইকি নিজে অবিবাহিত ছিল। এতে সাইকির বাবা পড়লেন মহা সমস্যায়। তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না, এমন মহাসুন্দরী মেয়েকে নিয়ে কী করবেন। কার সঙ্গেই বা বিয়ে দেবেন। মাথা কাজ না করায় সাইকির বাবা যিনি একজন আসলে রাজা ছিলেন, অ্যাপোলোর ওরাকলের সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করলেন।
আসলে এই অ্যাপোলো ছিলেন একজন জ্যোতিষী। তিনি যা বললেন, তাতে সাইকির বাবার মাথা ঘুরে গেল। অ্যাপোলো জানালেন, সাইকির ভয়াবহ পরিণতি হবে। কেননা, সাইকি থাকলে রাজ্যে প্লেগের মরক শুরু হয়ে যাবে। তাই সাইকিকে ত্যাগ করতে হবে। তা না হলে গোটা রাজ্যবাসীরও দুর্দশার সীমা থাকবে না। সাইকির বাবা প্রশ্ন করলেন, এখন উপায়?
অ্যাপোলো জানালেন, সাইকিকে কালো পোশাক পরিয়ে এক্কেবারে পাহাড়ের চূড়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হোক। তাহলে সেখান থেকে এক ডানা ওয়ালা সাপ এসে সাইকিকে নিয়ে অন্য জায়গায় চলে যাবে। রাজ্য এবং রাজ্যের মানুষ দুর্দশা থেকে বেঁচে যাবে। সাইকির বাবা তাই করলেন। গোটা রাজ্যের মানুষ এতে মনে মনে খুব কষ্ট পেল। সাইকির মতো সুন্দরীকে এভাবে ত্যাগ করা তারা একেবারে মন থেকে মানতে পারছিলেন না। কিন্তু রাজা তাঁর মেয়েকে নিয়ে কী করবেন, তাতে তো আর তারা নাক গলাতে পারে না। সুতরাং সবাই কেঁদে কেটে সাইকিকে বিদায় জানাল।
এদিকে প্রেমের দেবতা কিউপিড তখন সেই পাহাড়ে সাইকির জন্য অপেক্ষা করছিল। তাঁর তির-ধনুক নিয়ে তৈরিই ছিল। সাইকিকে দেখতে পেয়েই দিল চালিয়ে। সাইকি কিউপিডকে না দেখেই শুধু আওয়াজ শুনেই দিওয়ানা হয়ে গেল। অনেকটা এখনকার ফেসবুক প্রেম আর কি! প্রোফাইল দেখেই সবকিছু উজার করে দেওয়ার কশম খেয়ে ফেলা। অন্যদিকে, সাইকিকে দেখে কিউপিড তো পাগল হয়েছিলই। ফলে দুজনেই দুজনের প্রেমে পড়ে গেল। এবং একসঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নিল।
কিন্তু এতে কিউপিডের মা ভেনাস রেগে গেল। কেননা, তিনি শুধু প্রেম করতে বলেছিলেন, বিয়ে কিংবা সংসার নয়। কিন্তু কিউপিড সে কথা শুনল না। অর্থাৎ ভেনাসের চাল উলটো পড়ে গেল। রেগে ভেনাস কিউপিডকে অভিশাপ দিল – যেদিন সাইকি কিউপিডের আসল রূপ দেখে ফেলবে সেদিনই কিউপিডকে স্বর্গে ফিরে যেতে হবে। সাইকিকে একদিন কিউপিড সত্যি কথাটা বলেই ফেলল। জানাল, যে সে আসলে একজন দেবতা। তাঁর অপরূপ সুন্দর শরীর রয়েছে।
কিন্তু সেই শরীর মানবী সাইকি যেদিনই দেখবে, তাঁকে স্বর্গে চলে যেতে হবে। সুতরাং সাইকিকে হাওয়ার সঙ্গে সংসার করতে হবে। সাইকি কিউপিডের প্রেমের তির খেয়ে এতটাই মশগুল ছিল যে সেটাই মেনে নিল। আর দুজনে সুন্দর সংসার করতে লাগল।
কিন্তু সাইকির এমন সুন্দর সাংসারিক জীবনের খবর তাঁর দুই বোনের কাছে পৌঁছতে দেরি হল না। তাঁরা তো হিংসায় জ্বলে যেতে লাগল। কেননা, সাইকি এতবেশি সুন্দরী ছিল যে তাঁদের সহ্য হত না। তাঁরা ভেবেছিল, রাক্ষসের পেটে গিয়ে সাইকি তাঁদের উদ্ধার করেছে। কিন্তু খবর এল উলটো। সুতরাং সাইকির সুখের সংসারে আগুন ধরাতে তাঁরা একটা ষড়যন্ত্র করল। সাইকিকে তাঁরা উস্কে দিল। বলল, কিউপিড আসলে মিথ্যা বলেছে। সে সত্যি সত্যিই সুন্দর কি না সেটা জানতে সাইকির উচিত অন্তত একদিন নিজের চোখে কিউপিডের আসল রূপ দেখা। সাইকির কথাটা বেশ মনে ধরল।
বোনেদের কথা শুনে সাইকি তাই করল। রাতে শুধু একটা ইয়া মোটা মোমবাতি জ্বালিয়ে কিউপিডকে খুঁজতে লাগল। স্বামীকে ঘুমন্ত অবস্থায় পেয়েও গেল। হাজার হোক, কিউপিড তো আসলে একজন দেবতা। সুতরাং দেখতে মন্দ ছিল না। সাইকি খুব খুশি হল। যাক তাঁর স্বামী তাঁকে সত্যি কথাই বলেছে। কিন্তু অসাবধনতা বশত মোমবাতির কয়েক ফোটা গলিত মোম ঘুমন্ত কিউপিডের গায়ে পড়ে গেল। আর কিউপিডও ধরফড় করে জেগে উঠল। আর জেগে উঠেই রেগে গেল। এটা কী হল? এত করে বলা সত্ত্বেও সাইকি কেন তাঁর আসল রূপ দেখতে এল? রেগে কিউপিড হাওয়ায় মিলিয়ে গেল মানে ওই যে স্বর্গে ফিরে গেল। যখন এই কান্ড ঘটল, সাইকির গর্ভে তখন সন্তান এসেছে।
কিউপিডকে ফিরে পেতে সাইকি একেবারে মরিয়া হয়ে উঠল। ভেনাসের কাছে কিউপিডকে ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানাল। কিন্তু ভেনাস হেসে উড়িয়ে দিল। এরপর সাইকি সেক্স ও সৌন্দর্যের আরেক দেবী অ্যাফ্রোডিয়েডের কাছে কাতর আবেদন জানিয়ে সব বলল। দেবী অফ্রোডিয়েড সাইকিকে অমানবিক ৪টি কাজ দিল। সাইকি ৩টি কাজ করেও ফেলল। ৪ নম্বর কাজটি ছিল পাতালপুরিতে গিয়ে পাতাল দেবীর কাছ থেকে বিশেষ বিউটি ক্রিম নিয়ে আসা। সাইকি মৃত্যুপুরিতে গিয়ে সেটাও প্রায় করেই ফেলেছিল।
কিন্তু সেই বিউটি ক্রিম হাতে পাওয়ার পর সাইকি ভাবল, এটা একবার ব্যবহার করলে কেমন হয়। হতে পারে তাঁকে আরও সুন্দরী দেখাবে। মানে, স্বামীকে ফিরে পাওয়ার থেকে নিজের সৌন্দর্য নিয়ে ভাবতে গিয়ে ফের ফ্যাঁসাদে পড়তে হল সাইকিকে। বিউটি ক্রিমের বাক্স খুলতেই তাঁকে মৃ্ত্যুপুরীতে তলিয়ে যেতে হল।
এদিকে, কিউপিডের রাগ কমে গিয়েছিল। ভেনাসের কারণে সাইকির এই কষ্ট তাঁর আর সহ্য হচ্ছিল না। সুতরাং সে গিয়ে একেবারে দেবতাদের রাজা জিউসের কাছে দরবার করল। সবকথা খুলে বলে জানাল, সাইকির সঙ্গে যা ঘটছে সবই হচ্ছে ভেনাসের চক্রান্ত। আর দেবী অ্যাফ্রোডিয়েড ভেনাসের চক্রান্তে সামিল হয়েই সাইকিকে মৃত্যুপুরিতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে।
সব শুনে জিউস দেবতাদের আদেশ দিল সাইকিকে মৃত্যুপুরি থেকে অমৃতপুরিতে নিয়ে আসতে হবে। তাই হল, সাইকি স্বর্গে কিউপিডের কাছে এলেন এবং অমৃত পান করে দেবী হয়ে ওঠলেন। এরপর সাইকির এক মেয়ে হল। যার নাম ভোলপ্টাস। যাঁকে গ্রিক ও ল্যাটিন সাহিত্যে আনন্দের দেবী বলা হয়।
সারমর্ম (The meaning of the myth)
অনেকেই এই গল্পের পিছনে একটা নীতিকথা দেখতে পান। আসলে এই গল্পের আড়ালে কিভাবে এক পবিত্র ভালোবাসা সেক্সের খপ্পড়ে পড়ে অতলে তলিয়ে যায় সেটা বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে।