ভালোবাসা বা প্রেম মানুষের জীবনে ভীষণভাবে প্রভাব বিস্তার করে। সারা পৃথিবীতে প্রেমের মনস্তত্ব নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে, এখনও হচ্ছে। প্রেম এমন একটি বিষয় যার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি প্রবল। মানুষের শরীরে ও মস্তিস্কে কিভাবে প্রভাব বিস্তার করে এই প্রেম বা ভালোবাসা, তা নিশ্চই জানতে চান? আওনি জেনে অবাক হবেন প্রেম কীভাবে শরীর ও মস্তিকে কী বিচিত্র প্রভাব ফেলে।

কামনা বা ইচ্ছে –

গবেষকরা তাদের গবেষণার সুবিধার জন্য ভালোবাসাকে তিন পর্যায়ে ভাগ করেন। কামনা, ভালোলাগা ও আনুগত্য। কামনার পর্যায়ে শরীরের ভেতরে রীতিমত হরমোনের প্লাবন ঘটে যায়। আর এই সময় হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে যায় এমনকি হাতের তালু ঘামতে থাকে, এসবই ঘটে অ্যাড্রেনালিন ও নরপিনেফ্রিম নিঃসরণের । এরপর আছে উচ্ছাস যার উৎসাহ পায় ডোপামিনের কারণে। এটা অনেকটা ড্রাগ এডিকসনের মতো কাজ করে। ডোপামিন বেশী নিঃসরণ হলে শক্তি বারে, ঘুম আর খাওয়ার ইচ্ছে কমে যায়। কিন্তু প্রেমের প্রতি মনোযোগ ভীষণভাবে বেড়ে যায়।

একজনকে দেখে যখন ভালোলাগা অনুভূত হয় তখন সাথে সাথে শরীরে সমস্ত ব্যাথা কমে যায়। মস্তিস্কের যে অংশে মরফিনগুলো কাজ করে , এই ভালোলাগা অনুভূতিটিও কার্যকর হয়। এবং শরীরের ব্যাথা কমে যায়। ভালোবাসার  মানুষটিকে পাবার লক্ষে উদগ্র বাসনা জাগে। এই অবস্থা পেইন কিলারের মতো কাজ করে।  সেরোটোনিন হরমোনটিই নির্ধারন করে কাকে এবং কেন সে পছন্দ করতে চাইছে। মস্তিস্কে যুক্তি এসে তাকে সেই কাঙ্ক্ষিত নারীর প্রতি বাসনা বা ইচ্ছা প্রকাশ করতে প্রস্তুত করে।

মনোরোগ বিশষজ্ঞ ডোনাটেলা মারাজ্জিতি একটি গবেষণা করেন, সদ্য প্রেমে পড়া বাবা সারাক্ষোন ভালোবাস্রা মানুষটির কথা চিন্তা করার কথা পাত্রপাত্রী রক্ত পরীক্ষা করে পেয়েছেন তাদের রক্তে আর নেশাগ্রস্ত ব্যক্তির রক্তে সমপরিমাণ সেরোটোনিন পাওয়া গেছে।

ভালোলাগা বা  আকর্ষণ –

প্রেমের দ্বিতীয় পর্যায়ে অর্থাৎ ভালোলাগে’তে আর একটি ঘটনা লক্ষ্য করা যায়, মস্তিস্কে রক্ত সঞ্চালন দ্রুত হয়, এবং মস্তিস্কের ‘Pleasure Centre’ বা সুখ কেন্দ্রগুলিতে প্রচুর পরিমানে রক্ত সঞ্চালন ঘটতে থাকে। এইসময় একে অপরের সাথে সম্পর্ক স্থাপন ও তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার কথা চিন্তা করতে শুরু করেন।  

মস্তিস্কে ‘Obsessive  Compulsion Disorder’ বা OCD শুরু হয়। এই সময় পাত্র-পাত্রীর জেদ বা একগুঁয়ে স্বভাব দেখা যাবে। প্রেমে আসক্ত হয়ে এই সময় কেউ কারো দোষ বা ত্রুটী দেখতে পান না বা দেখতে চানও না, ক্ষমাশীল দৃষ্টিতে দেখেন। একে অপরের সকল বিষয়কে মেনে নিয়ে ভালোবাসতে শুরু করে। দুজন দুজনের প্রতি যেন তারা অন্ধ।  

এলেন বারসাইড তাঁর গবেষণায় পেয়েছেন প্রেমিক প্রেমিকা একটি আদর্শ মেনে চলেন, তাদের কাছে দেজনের সম্পর্কই সেই সময় সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপুর্ণ। আর এই ভাবনাই তাকে সম্পর্ক পরিণতির বা সংযুক্তির দিকে নিয়ে যেতে সাহায্য করে।

আনুগত্য বা সংযুক্তি –

এইভাবে ভালোবাসা এসে পৌঁছায় আনুগত্যের পর্যায়ে। রাগ অনুরাগ, দেয়া নেয়া, দীর্ঘ সময় কাটানোর অভিজ্ঞতা, সম্পর্কের নিবিড় অনুভুতি সবই একে অপরের কাছে নিবেদিত হতে সাহায্য করে। এই সময় আগের মতো উচ্ছাস থাকে না, অক্সিটোসিন আর ভ্যাসোপ্রেসিন নামে দুই হরমোন নিঃসরণের ফলে মস্তিস্কে তৈরি হয় একে অপরের প্রতি নিরাপত্তা ও স্থিতাবস্থা। এবং খু সংগত কারণে একে অপরকে মেনে নিয়ে সম্পর্ক সাথী করার লক্ষ্যে বিবাহ বা লিভ টুগেদাররের দিকে পা বাড়ায়।

ভালোবাসায় ভাঙ্গন

দীর্ঘদিন একসাথে কাটালেন। একে অপরকে পরতে পরতে অনুভব করলেন কিন্তু একটা সময় এসে দুজনেরই মধ্যে একঘেয়েপনা পেয়ে বসে। এক্ষেত্রে একটা কথা বলতে হয় মানুষ কখনই কোনো বিশয়কে দীর্ঘ স্থায়ী করতে পছন্দ করে না। একসময় যে তাকে না পেলে মৃত্যুর মতো বিষটিকেও মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল, আজ সেই সম্পর্কে ছানা কেটে গেছে। পীরিতের কাঁঠালের আঠা আজ অনেকটাই কম আঠালো। যা ছাড়তেও পারে।

দেখা যায় একে অপরের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করছেন না। সাড়া দিতে দেড়ি করছেন। মানসিক চাপ , অর্থনৈতিক অভাব, যৌনতায় একঘেয়েমি  ইত্যাদি নানা কারণে সম্পর্কে চীর ধরে। সম্পর্কের এই সমপ্য বিশেষজ্ঞের মতামত নেয়া খুব দরকার।

এক্ষেত্রে কি করবেন আর কি করবেন না।
  • আগে থেকে পরিকল্পনা করা আছে এমন কাজের বাইরে বেড়িয়ে হুটহাট করে কোথাও ঘুরতে যাবার প্ল্যান করতে পারেন। 
  • দুজনের সাথে দুজন অনেক বেশী সময় কাটান, কথা বলুন।
  • দুজন দুজনকে আরো গভীরভাবে জানার চেষ্টা করুন।
  • নিজের পক্ষ নিয়ে শুধু নিজেরটুকুই নিয়ে একে অপরপকে দোষারোপ করবেন না।
  • একজন অপকে সম্পত্তি মনে করবেন না। এটা করলে সেই সম্পর্ক কখনই দীর্ঘায়িত হবে না। বরং একে অপরের সম্পদ মনে করুন। দুজনে দুজনকে পেয়ে ভীষণ ভাগ্যবান মনে করবেন।
  • দুজন দুজনের ভুল না দেখে, বা তার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ না করে, সমস্যাটা নিয়ে পজিটিভ ভাবনায় নিজেকে যুক্ত করুন।
  • একে অপরের প্রতি হিসেব নিকেশের ভাবনায় যাবে না।
  • কেউ কাউকে অসম্মান করবে না।

ভালোবেসে আপনিই শুধু কষ্ট পেয়েছেন, ঠকে গেছেন। এই ভাবনা দ্রুত একে অপরের প্রতি এমন সব আচরণ করতে বাধ্য করবে যাতে কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারবেন না। এবং এখানেই বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে পড়বে।

বিচ্ছেদের পর মস্তিস্ক থেকে করটিসল নামক হরমোনের নিঃসরণ ঘটে। এতে মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায়। শরীরে আঘাত পেলে বা রক্তক্ষরণে যে ব্যাথা অনুভূত হয়  ঠিক একই ব্যাথা এই বিচ্ছেদের পর অনুভূত হয়।

তবে কি মানুষ ভালোবাসবেন না। বাসবেন, বারে বারে প্রেমে পড়বেন, আবার আঘাত আসবে, তাকে মেনে নিতে হবে। কারন জীবন কখনও থেকে থাকে না। তাই ভালোবাসার মৃত্যু নেই। বিবর্তন আছে।

Previous articleValentine day : মনের মানুষকে মনের কথা বোঝাতে কোন রংয়ের গোলাপ দেবেন, দেখে নিন
Next articleBreak Up/প্রেমে ধাক্কা খেলে নিজেকে বাঁচাতে যা অবশ্যই করা উচিত