শাহরুখ খানের ডাঙ্কির পোস্টার

একটা সময় বড়ই মন্দ গিয়েছিল। কিন্তু ২০২৩ সাল থেকে ফের ফের ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন বলিউডের কিং খান। সেই শুরু হয়েছিল, বক্স অফিসে শাহরুখ ঝড় (Shah Rukh Khan) দিয়ে। জানুয়ারি মাসে মুক্তি পায় ‘পাঠান’ (Pathan)। এরপর সেপ্টেম্বরে আসে ‘জওয়ান’ (Jawan)। নিজের রেকর্ড নিজেই ভাঙেন কিং খান (King Khan)। আর এবার বছর শেষে মুক্তি পেল ‘ডাঙ্কি’ (Dunki)।

একদিকে শাহরুখ খান (Shah Rukh Khan), অন্যদিকে রাজকুমার হিরানির (Rajkumar Hirani) পরিচালনা। এই কম্বো বড়পর্দায় কতটা কামাল করতে পারে তা দেখার আশায় ছিলেন অনুরাগীরা। বলাই বাহুল্য ২১ ডিসেম্বর, আজ, বৃহস্পতিবারও ভোর থেকে দেশের নানা প্রান্তের প্রেক্ষাগৃহে হাজির হয়েছিলেন শাহরুখ অনুরাগীরা। শীতের ভোরে আড়মোড়া ভেঙে দূর-দুরান্ত থেকে আসা ভক্তদের মন জয় করতে পারলেন বাদশাহ?

২১ ডিসেম্বর মুক্তি পেল শাহরুখ খানের এ বছরের তৃতীয় ছবি ডাঙ্কি। কেমন হল সেটাই এবার বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক। একদিকে থাকে সুদিনের স্বপ্ন, হাতছানি। আরেকদিকে বাড়ি, পরিবার, আত্মীয়, চেনা মুখ সবটা ছেড়ে চলে যাওয়ার কষ্ট। তবুও সবটা মেনে অনেকেই সুদিনের আশায়, স্বপ্নপূরণের লক্ষ্য নিয়ে পাড়ি দেন বিদেশে। কেউ কেউ আবার আইনি ভাবে ভিসা না পেয়ে বেছে নেন বেআইনি পথ। ডঙ্কি পদ্ধতি প্রবেশ করেন ভিনদেশে। কী হয় তাঁদের সঙ্গে সেটারই এক নিদারুণ গল্প উঠে এল রাজকুমার হিরানির এই ছবিতে।

প্রথমেই বলে রাখা ভাল ‘পাঠান’ ও ‘জওয়ান’ দেখার পর যদি ‘ডাঙ্কি’ ছবিতেও সেই ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ (larger than life) শাহরুখ খানকে খুঁজতে চান, তাহলে খানিক হতাশ হতে হবে। সেই হিরোইজম না থাকলেও এই ছবির ‘নায়ক’ অবশ্যই শাহরুখ। তবে তা পুরোটাই পরিচালক রাজকুমার হিরানির মোড়কে তৈরি নায়ক। অবশ্য বারবার ফিরে পাবেন সেই ‘রোম্যান্টিক’ শাহরুখ খানকে। যাঁর চোখে আজও বারবার মন হারায় দেশের মহিলারা। ট্রেলার দেখে অনেকেই ভেবেছিলেন যে ছবি খুব অসাধারণ হবে না, হয়তো তেমন ঝড় তুলতে পারবে না, কিন্তু সিনেমাটা ততটাই প্রাণবন্ত। এতে যেমন অ্যাকশন পাবেন, তেমনই মিলবে রোম্যান্সের ঝলক, আবেগ, পরিবারের বাঁধন সবটাই, তবে সবটাই একেবারে যতটা প্রয়োজন ততটাই। আবার একথাও ঠিক, রাজকুমার হিরানির ‘পিকে’, ‘থ্রি ইডিয়টস’-এর মতোও মন হয়তো জয় করতে পারবে না ‘ডাঙ্কি’। 

(Dunki) ডাঙ্কির গল্প

পাঞ্জাবের এক গ্রামের কয়েকজন বন্ধু লন্ডন যেতে চায়, আরও একটু ভাল জীবনযাপনের আশায়। কারও মা সেলাই করে সংসার টানেন, কারও মা সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করেন, কেউ আবার নিজে ধাবায় কাজ করে রাতদিন মালিকের কুকথা শোনে। আর এদের মাঝে হঠাৎই এসে উপস্থিত হন ‘হার্ডি’ শাহরুখ খান। ফৌজি হার্ডির প্রাণ বাঁচিয়েছিল এক পাঞ্জাবী ছেলে। সেরে উঠে তাকে খুঁজতে গিয়েই এই বন্ধুদের দলের সঙ্গে আলাপ হার্ডির। তাদের সকলের লন্ডন যাওয়ার স্বপ্ন সত্যি করতে সাহায্যের হাত বাড়ায় ফৌজি।

হার্ডি পেশায় একজন সেনা অফিসার ছিলেন। যিনি গুলিবিদ্ধ হলে এক অ্যাথলিট তাঁকে বাঁচায়। এরপর সেই অ্যাথলিটের টেপ রেকর্ডার যা হার্ডির কাছে থেকে গিয়েছিল সেটা তিনি তাঁর বাড়িতে ফেরত দিতে গিয়ে প্রেমে পড়েন মনুর। খুঁজে পান নতুন করে বাঁচার মানে। খুঁজে পান অনেক বন্ধুও। ঘটনাচক্রে মনু এবং তাঁর বন্ধুরা নিজেদের ভবিষৎ ভালো করার জন্য বিদেশ যেতে চান।

কিন্তু এই ‘উল্লু দে পটঠো’র না আছে আর্থিক প্রাচুর্য না আছে ইংরেজি শিক্ষা। ফলে লন্ডনের ভিসা পাওয়া অসম্ভব। তখনই বিকল্প পথের ভাবনা। সিদ্ধান্ত নেওয়া হল তারা বেছে নেবে ‘ডাঙ্কি রুট’ অর্থাৎ বেআইনি পথে একাধিক দেশের কাঁটাতার পেরিয়ে লন্ডনে পৌঁছনো। তারপর? আদৌ কি তারা পৌঁছতে পারবে ইংল্যান্ড? উত্তর পেতে অবশ্যই দেখতে হবে ‘ডাঙ্কি’। 

কেমন হল Dunki?

‘পাঠান’ বা ‘জওয়ান’ ছবির মতো ‘ডাঙ্কি’ শাহরুখ খানের চেয়েও বেশি রাজু হিরানির ছবি। আগের দুই ছবিতে শাহরুখের ‘কামব্যাক’ দেখেছেন দর্শক, তাঁকে উদযাপন করেছেন, ‘ডাঙ্কি’তে তিনি যেন থিতু হতে চেয়েছেন পরিচালকের হাতে। ছবির মেকিং অত্যন্ত সুন্দর। এই সিনেমা আপনাকে হাসাবে, কাঁদাবে, প্রেমে ফেলবে, স্বপ্ন দেখাবে, উদ্বিগ্ন করবে, ভাবাবে। সবচেয়ে বড় কথা, এই ছবি আপনাকে বিদেশে দুর্দান্ত জীবনযাপনের স্বপ্নের উল্টো পিঠটাও দেখাবে। সাধারণ মানুষের কাছে বিদেশের মাটি মানেই যে ঐশ্বর্যের ভাবনা থাকে, তা কতটা বাস্তবে ঘটে, তা বলবে এই ছবি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেআইনিভাবে কাঁটাতার পেরিয়ে যে মানুষেরা পৌঁছয় বিদেশের মাটিতে, কেমন হয় তাদের জীবন? আদৌ কি তারা পৌঁছতে পারেন সবসময়? বলে রাখা ভাল, এখানে গোটা ছবি ধরে শাহরুখ খানই রাজত্ব করেছেন এমন নয়, একই পরিমাণ প্রাধান্য পেয়েছে প্রত্যেকটা চরিত্র। 

Dunki-তে কে কেমন অভিনয় করল?

শাহরুখের এই বছর মুক্তি পাওয়া পাঠান বা জওয়ানের থেকে ডাঙ্কি অনেক আলাদা। অ্যাকশন থেকে দর্শক এবং ভক্তদের অন্য কিছু উপহার দিলেন কিং খান বড়দিনে। তাঁর হিউমার সেন্স এবং কমিক টাইমিং নিয়ে নতুন করে কী বলি! তাঁর ডায়লগ এবং সাবলীল অভিনয় দেখে আপনি খিলখিলিয়ে হাসতে বাধ্য। আবার তেমনই কোনও ইমোশনাল বা রোম্যান্টিক সিনে তাঁর অভিনয় বরাবরের মতোই নজর কেড়েছে।

অন্যদিক তাপসী পান্নু ফাটিয়ে দিয়েছেন। বাই গড বলছি অভিনেত্রীকে বয়স হলে কিন্তু সেই লাগবে। কিন্তু এই ছবিতে তাঁকে কখনও কখনও কেন যে ঋদ্ধি ডোগরা আর অমরদীপ ঝার মতো লাগল বুঝলাম না!

বিক্রম কোচ্চার, অনিল গ্রোভার নিজ নিজ ভূমিকায় যথাযথ। তবে অল্প সময়ে আলাদা ভাবে নজর করলেন ভিকি কৌশল। তাঁর মনোলগ হোক বা ইমোশনাল কোনও সিন সবেতেই যেন ছাপিয়ে গিয়েছেন সকলকে।

Dunki তে শাহরুখের অভিনয় কেমন?

শাহরুখ খান তাঁর ‘ক্যারিশমা’ দিয়েই ফের মন জয় করেছেন। আবারও তাঁর চোখ কথা বলেছে। হার্ডির হয়ে পছন্দের মানুষের রুখে দাঁড়ানোই হোক বা প্রিয় মানুষের দূরে চলে যাওয়া, সংলাপ নয়, কথা বলেছে তাঁর দুই চোখ। ফের আট থেকে আশিকে প্রেমে ফেলতে পেরেছেন তিনি। কিন্তু সেখানেও তিনি নিজের পরিমাণ মেপেছেন। যার ফলস্বরূপ তাঁর তারকাসুলভ ‘দ্যূতি’র সামনে বাকিদের উপস্থিতি ফিকে হয়ে যায়নি। তাপসী পন্নু নিজের চরিত্রে দুর্দান্ত। কিন্তু শাহরুখ ও তাপসীর রসায়ন তেমন ছাপ ফেলতে পারেনি মনে। কোথাও যেন একটা তাল কাটছিল। স্পেশাল অ্যাপিয়ারেন্সে ভিকি কৌশল নজর কেড়েছেন। ছোট চরিত্রেও প্রমাণ করেছেন নিজের ক্ষমতা। বোমান ইরানির অভিনয় দক্ষতা নিয়ে তো বলার কিছুই নেই, এককথায় অনবদ্য। বিক্রম কোছার ও অনিল গ্রোভারও তাল মিলিয়ে অভিনয় করেছেন এবং নজর কেড়েছেন। 

মূল চরিত্রদের দুই ধরনের লুক দেখানো হয়েছে ছবিতে। প্রথম যখন যুবক-যুবতী বয়স, দ্বিতীয় লুক ২৫ বছর পরের। সেক্ষেত্রে মেকআপে আরও একটু নজর দিলে ভাল হত। সেপ্টেম্বরেই মুক্তি পেয়েছে ‘জওয়ান’। সেখানে ইতিমধ্যেই বৃদ্ধ লুকে শাহরুখকে দর্শক দেখে ফেলেছেন, তাঁর প্রেমেও পড়েছেন। তারপর ‘ডাঙ্কি’ ছবিতে শাহরুখের বৃদ্ধ লুক তেমন একটা জমেনি। 

Dunki-র পরিচালক কেমন কাজ করলেন?

রাজকুমার হিরানির ছবি চিরকালই দর্শকের প্রিয়। সমস্ত আবেগের নিঁখুত মিশেলে মন জয় করেন তিনি প্রতিবার। তাঁর পরিচালনায় শাহরুখ খানের প্রথম অভিনয়, কিন্তু এই ছবিতে যে পরিচালকই শেষ কথা, তা বেশ বোঝা গেছে। সেই কারণেই হয়তো ‘ডাঙ্কি’ ভাল লাগবে দর্শকের। পরিচালক নিজের ঢঙে গল্প বলেছেন। কিং খানের ‘বীরত্ব’ দেখানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়েননি, তা সত্ত্বেও শাহরুখকে সেলিব্রেট করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে দর্শকের কাছে। ফলে সাধারণ মানুষ প্রত্যেক চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম বোধ করবেন।

ছবির গানও মন ছোঁবে। প্রীতমের সুরে যেমন ‘লুঠ পুট গয়া’ গান শুনে ঠিক প্রথম প্রেমে পড়ার মতো হৃদয়ে ‘ধুকপুক’ বাড়বে আবার ‘ও মাহি’ গানে অরিজিতের কণ্ঠে প্রেম ডালপালা মেলবে। সোনু নিগমের কণ্ঠে ‘নিকলে থে কভি…’ চোখে জল আনবে। সবকটা গানই বেশ মানানসই, সঠিক সময়ে ব্যবহৃত। 

সবমিলিয়ে ২০২৩ সালের শেষটাও শাহরুখের হাত ধরে মন্দ হবে না। এই ছবি বক্স অফিসে কেমন ঝড় তুলবে তা সময় বলবে, কিন্তু প্রেক্ষাগৃহে সপরিবারে গিয়ে শীতের ছুটির মেজাজ উপভোগ করে আসতেই পারেন ‘ডাঙ্কি’র সঙ্গে। 

ওভারঅল কেমন লাগল Dunki?

সিনেমাটোগ্রাফি ভীষণই ভালো। বিশেষ করে শাহরুখ খানরা ভারত থেকে ডঙ্কি পদ্ধতিতে যখন লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন সেই সময় নদীর মধ্যে সিন বা ইরানের মরুভূমির দৃশ্য বিশেষ ভাবে নজর কেড়েছে। তুর্কি যাওয়ার পথে শাহরুখ তাপসীর ট্রেনের সিন মনে থাকবে। এমন টুকটাক অনেক দৃশ্য রয়েছে যা ছবি, গল্প বা অন্যান্য সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়ে বিশেষ ভাবে মনে দাগ কেটেছে। গল্পের বাঁধন বড়ই সুন্দর, কোথাও এতটুকু ঝিমিয়ে পড়তে দেননি পরিচালক। বরং এক মুহুর্তে কাঁদিয়ে পর মুহূর্তে হাসিয়েছেন। প্রথম দিকে শাহরুখের লালটুতে এন্ট্রি সিনে দর্শকরা বুঝে উঠতে পারছিলেন না যে জাতীয় সঙ্গীত শুনে উঠে দাঁড়াবেন নাকি হাসবেন। আবার তেমনই শেষ দৃশ্যে যখন প্রাণভরে সকলে হাসতে শুরু করেছিলেন তখনই ইমোশনাল টুইস্ট মন খারাপ করে দেয়। আবার দেশ ছাড়ার আগে মাটি নিয়ে যাওয়া বা দেশে ফিরে খালি পায়ে হাঁটা সবটাই এক অনন্য মুহূর্ত তৈরি করেছিল। তাই সবটা মিলিয়ে দুর্দান্ত লাগল শাহরুখের এই ছবি। ছবির সংলাপ অনুযায়ী এখন এটাই দেখার যে ‘হ্যাট্রিক হয় কিনা!’

ছবি হিট করে হ্যাট্রিক করবে কি না সেটা তো সময় বলবে। তবে এই ছবি যে অনেক কিছু শেখাল সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। সংলাপ থেকে শেষের নোট সবটাই শিক্ষণীয়। তবে বেশি করে যে সংলাপ নজর কাড়ল সেগুলো হল, ‘পাখিরা যেটা বোঝে মানুষ কেন বোঝে না যে প্রয়োজন না হলে কেউ নিজের ঘর ছাড়তে চায় না’ এবং ‘আমার দেশ আমারই। সেটা যেমনই হোক আমার। আমার দেশে আমার কোনও মৃত্যুভয় নেই।’

ছবির প্রতিটা গান এত বেশিই অ্যাকিউরেট যে কোনওত শুনেই মনে হয়নি যে সেটা জোর করে ঢোকানো হয়েছে। বরং প্রতিটা পরিস্থিতির সঙ্গে গানগুলো যেন ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে।

Dunki-র খারাপ বিষয়

হ্যাঁ, একটা বিষয় বড়ই চোখে লাগল। বয়স হওয়ার পর শাহরুখ, তাপসীর মুখের চামড়া কুঁচকে গেলেও হাতের চামড়া ঠিক ছিল। এই দিকে বোধহয় নজর দেওয়া উচিত ছিল। ওভারঅল একটা ইমোশনাল রোলার কোস্টার রাইড চড়ার জন্য, ভরপুর হাসার জন্য বড়দিনের ছুটিতে এই ছবি একদিন নির্দ্বিধায় দেখে আসা যেতে পারে।

ছবি: ডাঙ্কি

পরিচালক: রাজকুমার হিরানি

অভিনয়: শাহরুখ খান, তাপসী পান্নু

রেটিং: ৪.৮/৫

Previous articleAnimal vs Sam Bahadur: ‘অ্যানিম্যাল’ রণবীরের বিরুদ্ধে ‘স্যাম বাহাদুর’ ভিকি, রুপোলী পর্দায় কে কাকে হারাবে
Next articleঐশ্বর্যার প্রাক্তন প্রেমিক সলমনকে দেখা মাত্রই জড়িয়ে ধরলেন অভিষেক, ব্যাপার কি