সেই সময়ের নবাগত নায়ক শাহরুখের বিপরীতে নায়িকা হিসাবে যাঁকে দেখা গিয়েছিল, তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই অগণিত পুরুষ হৃদয়ে ঝড় তুলেছিলেন। তিনি দিব্যা ভারতী (Divya Bharti)।
অল্প সময়ের কেরিয়ারেই বলিউড রাজত্ব করতে শুরু করেছিলেন দিব্যা (Divya Bharti)। সেই সময় বলিপাড়ায় নায়িকাদের মধ্যে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকও পেতেন তিনি। বলিউডে পা রেখেই একের পর এক ছবি। উল্কার গতিতে উত্থান।
সকলেই ভেবেছিলেন, দিব্যা লম্বা রেসের ঘোড়া। কিন্তু আচমকাই রুপোলি পর্দার মায়াবী আকাশ থেকে খসে পড়ল সেই তারা। মাত্র ১৯ বছর বয়সে মৃত্যু হয় এই সুপারহিট নায়িকার।
২৮ বছর পরেও বলি অভিনেত্রী দিব্যা ভারতীর (Divya Bharti) মৃত্যুর কারণ অজানা। ১৯ বছর বয়সে পাঁচ তলা থেকে পড়ে মৃত্যু। হত্যা, আত্মহত্যা নাকি দুর্ঘটনা? সেই দিব্যার সম্পর্কে জেনে নিন কিছু তথ্য।
দিব্যার অভিনয় জীবন শুরুর কথা
১৯৭৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মুম্বইয়ে জন্ম। নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা। তারপর অভিনয়ে। তেলুগু ছবিতে দাগ্গুবাতি ভেঙ্কটেশের বিপরীতে শুরু।
১৯৯২ সাল। সে বছরই মুক্তি পেয়েছিল দিব্যার প্রথম হিন্দি ছবি ‘বিশ্বাত্মা’। এই ছবির ‘সাত সমুন্দর পার’ এখনও সুপারহিট। বলিপাড়ায় পা রেখেই সেই সময় তুফান তুলেছিলেন দিব্যা।
বলিপাড়ায় দিব্যা যখন পা রেখেছিলেন, সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ১৭-১৮। উঠতি নায়িকা দিব্যা বক্সঅফিস মাতিয়ে দিয়েছিলেন। সুন্দরী তো বটেই, সেই সঙ্গে দিব্যার ‘বাবলি ইমেজ’ নজর কেড়েছিল সকলের।
শাহরুখ গোবিন্দার সঙ্গে সম্পর্ক
‘শোলা অউর শবনম’, ‘দিওয়ানা’ সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে দেয়। ‘দিওয়ানা’-তে শাহরুখ খানের বিপরীতে। সঙ্গে ছিলেন প্রয়াত অভিনেতা ঋষি কপূরও। তখন সবে বলিপাড়ায় পা রেখেছিলেন শাহরুখ খান। ১৯৯২ সালে ‘দিওয়ানা’ ছবি দিয়ে বি-টাউনে হাতেখড়ি হয়েছিল ‘পাঠানের’।
এই ছবিতে ছিলেন দিব্যা। সঙ্গে ছিলেন ঋষি কপূর। ‘দিওয়ানা’ ছবির দৌলতে তখন উঠতি নায়ক হিসাবে নজর কেড়েছিলেন শাহরুখ। সেই সঙ্গে শাহরুখ এবং দিব্যার জুটিও পছন্দ হয়েছিল দর্শকদের।
‘দিওয়ানা’ ছবির এই গানের দৃশ্যেই রুপোলি পর্দায় প্রথম বার কোনও নায়িকার সঙ্গে পা মেলাতে দেখা গিয়েছিল শাহরুখ খানকে। ‘অ্যায়সি দিওয়ানগি…’ বলিপাড়ার বিখ্যাত এই গানটির বয়স ৩০ বছরেরও বেশি হয়ে গিয়েছে। বয়স বাড়লেও গানটি এখনও একইরকম জনপ্রিয়।
‘শোলা অউর শবনম’-এ অভিনয়ের সময় গোবিন্দার সঙ্গে আলাপ। জানা যায়, তাঁদের মধ্যেও সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। দিব্যার সম্পর্কে গোবিন্দা বলেছিলেন, ‘‘দিব্যাকে আমার ভাল লাগে। এত মোহময়ী যে তাঁর সামনে পুরুষরা নিজেকে সামলাতে পারে না। কিন্তু দিব্যার মোহে পা দিইনি আমি এখনও।’’
মৃত্যুর ১ বছর আগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ
এই গোবিন্দার মাধ্যমেই দিব্যার পরিচয় হয় প্রযোজক সাজিদ নাদিওয়াদওয়ালার সঙ্গে। তার পর বন্ধুত্ব, প্রেম। ১৯৯২ সালের ১০ মে বিয়ে।
আর তারপরই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ। নতুন নাম সানা নাদিওয়াদওয়ালা। অভিনয়ে যাতে প্রভাব না পড়ে, বিয়ের কথা লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।
কিন্তু বিয়ের ১ বছর কাটতে না কাটতেই মৃত্যু হয় দিব্যা ভারতীর। ১৯৯৩ সালের ৫ এপ্রিল। মুম্বইয়ের ভারসোভায় নিজের বাড়ির বারান্দা থেকে পড়ে মৃত্যু হয় দিব্যার।
তাঁর মৃত্যু নাড়িয়ে দিয়েছিল বলিপাড়াকে। দিব্যার মৃত্যু এখনও এক রহস্য। কী ভাবে পড়ে গেলেন তিনি? কী হয়েছিল? এই ধোঁয়াশা কাটেনি। দিব্যার হাতে তখন একের পর এক ছবি।
দিব্যার মৃত্যু নিয়ে শাহরুখের বক্তব্য
দিব্যার অকালপ্রয়াণে বলিউডের বহু শিল্পীই হতচকিত হয়ে গিয়েছিলেন। নাড়া দিয়েছিল শাহরুখকেও। সেই সময় দিল্লিতে ছিলেন বলিপাড়ার সুপারস্টার। দিব্যার মৃত্যুর খবর কী ভাবে জেনেছিলেন?
এই প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মুখ খুলেছিলেন শাহরুখ। বলেছিলেন, ‘‘তখন দিল্লিতে ছিলাম। ঘুমোচ্ছিলাম। আচমকা শুনতে পেলাম বাজছে ‘অ্যায়সি দিওয়ানগি’ গান। ভাবলাম বড় তারকা হয়ে গিয়েছি। হঠাৎ কেন এই গান বাজানো হল, বুঝতে পারছিলাম না।’’
এর পরই শাহরুখ বলেন, ‘‘ সকালে ঘুম থেকে উঠে খবরে দেখলাম যে, ও (দিব্যা) আর নেই। খবরটা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, ওঁর সঙ্গে তো আরও একটা ছবি করার কথা ছিল।’’
দিব্যা প্রসঙ্গে সাক্ষাৎকারে শাহরুখ আরও বলেছিলেন, ‘‘খুব ভাল অভিনেত্রী ছিল দিব্যা। আমি একটু সিরিয়াস গোছের। কিন্তু দিব্যা খুবই মজার ছিল।’’
পরবর্তী কালে শাহরুখ-কাজল জুটি জনপ্রিয় হয়েছিল। অনেকেই বলেন, দিব্যার পরিণতি যদি এমনটা না হত, তা হলে শাহরুখ-দিব্যা জুটিও কাঁপাত বি-টাউন।
দিব্যার রহস্য মৃত্যুর পিছনে কোন কারণ
দিব্যার রহস্যমৃত্যু নিয়ে বই লিখেছিলেন ট্রয় রিবেইরো। ঘটনাস্থলে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে অনেক অজানা তথ্য প্রকাশ করেছিলেন। রিবেইরো নিজেও এক জন সাক্ষী।
ট্রয়ের বই অনুযায়ী দিব্যা মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন বহু দিন ধরে। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে মদ্যপান করেছিলেন। বাড়িতে একাধিক অতিথি এসেছিলেন। দিব্যা নিজের গ্লাস ভর্তি করে বারান্দায় একা সময় কাটাচ্ছিলেন। পড়ে যাওয়ার আওয়াজ শুনে সবাই ছুটে যান। ট্রয় জানিয়েছেন, অতিথিরাই হাসপাতালে নিয়ে যান। চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।
ট্রয়ের লেখা থেকে জানা যায়, দিব্যার বাবা ও ভাইকে সামলানো যাচ্ছিল না। বাবা কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘‘ওরা আমার মেয়েকে মেরে ফেলল!’’ ভোর বেলা দিব্যার মা হাসপাতালে পৌঁছন। তিনি বিশ্বাসই করছিলেন না। তবে হাসপাতালেই দিব্যার বাবা ও ভাই মাকে দোষারোপ করছিলেন। যার কারণ আজও অজানা।
মৃত্যুর সময় দিব্যার স্বামী কী করছিলেন
দিব্যার স্বামী সাজিদ নাদিওয়াদওয়ালা হাসপাতালে পৌঁছেছিলেন মৃত্যুর ঘণ্টা খানেক পরে। দিব্যার মৃতদেহ দেখে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন বলে জানিয়েছেন ট্রয়। তাঁকে আইসিসিইউ-তে ভর্তি করা হয়। জ্ঞান ফেরার পর স্ত্রীর মৃত্যু মেনে নিতে পারছিলেন না। ফের তাঁকে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেন চিকিৎসকরা।
দিব্যার এক অতিথি (ডিজাইনার নীতা লুল্লা) পুলিশকে জানান, কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সব কিছু ঘটেছে। তাই তিনি স্পষ্ট করে জানেন না যে দিব্যা আত্মহত্যা করেছিলেন, নাকি পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলেন।
দিব্যার এক বন্ধু পুলিশকে জানান, মৃত্যুর সময়ে নীতা তাঁর সঙ্গেই ছিলেন। দিব্যা বারান্দার রেলিংয়ের ধারে দাঁড়িয়ে আত্মহত্যার হুমকি দিচ্ছিলেন। নীতা বাঁচানোর জন্য এগোতে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে দিব্যার ঝাঁপ।
মৃত্যুর আগে স্বামীকে হুমকি
জানা যায়, সে দিন পার্টির আগে সন্ধেবেলা সাজিদের সঙ্গে ঝগড়া হয় দিব্যার। সাজিদ বা়ড়ি থেকে বেরিয়ে যান। দিব্যা হুমকি দিয়েছিলেন, ‘‘তুমি যদি ১০ মিনিটে ঘরে না ঢোকো, আমাকে আর দেখতে পাবে না।’’ দিব্যার বন্ধু জানায়, সাজিদ হুমকিকে পাত্তা দেননি।
দিব্যার আর এক প্রতিবেশী বলেন, সে দিন সাজিদের সঙ্গে ঝগড়ার পর অনেকগুলি ঘুমের ওষুধ খান দিব্যা। সাজিদ ভয় পেয়ে তাঁদের প্রতিবেশী নীতা লুল্লা ও তাঁর স্বামীকে ডাকেন।
তাঁরা এসে দিব্যার ভাই (সেই সময়ে দিব্যার ভাই তাঁর বাড়িতেই ছিলেন) এবং সাজিদকে বের করে দেন। বলেন, তিনি দিব্যার সঙ্গে আলাদা কথা বলবেন। পরিচারিকাকে থাকতে বলা হয়। তিনি ছিলেন রান্নাঘরে। দিব্যা রান্নাঘরে আরও মদ্যপান করে সবার অলক্ষ্যে বারান্দায় চলে যান। কয়েক মুহূর্ত পরেই সব শেষ হয়।
যে প্রশ্নের উত্তর আজও পাওয়া যায়নি
সবাই জানত, দিব্যা সব সময়ই আনন্দ আর হৈ হুল্লোড় করতে ভালো বাসতেন। কিন্তু প্রেমে পড়ে বিয়ে করার পর দিব্যার ধর্ম পরিবর্তন অনেককে চমকে দিয়েছিল। স্বাভাবিক কারণেই অনেকের মনে প্রশ্ন, ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে দিব্যা কোনও বাধার মুখে পড়েন নি তো?
খেয়াল করার মতো বিষয়, সেদিন পার্টিতে দিব্যার স্বামী সাজিদ ছিলেন না। পার্টির ঠিক আগে ঝগড়া হওয়ায় তিনি বাড়ি ছেড়ে চলে যান। তাহলে কি পার্টি নিয়েই কোনও ঝামেলা হয়েছিল? সাজিদ কি দিব্যার বিয়ের পর এধরনের পার্টি নিয়ে আপত্তি করতেন?
বইয়ের লেখক ট্রয় রিবেইরো তাঁর সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিতে চাননি পরিচারিকাকেও। তাঁর বক্তব্য, মৃত্যুর আগে পরিচারিকাই শেষ বার দেখেছিলেন দিব্যাকে। তিনি খাবার কিংবা অন্য জিনিসের সঙ্গে কিছু মেশান নি তো?
কিন্তু ট্রয়ের আক্ষেপ, পুলিশ এক বারও তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। কেন পরিচারিকাকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করল না? তাহলে কি পুলিশ কোনও ভাবে তড়িঘড়ি তদন্ত মিটিয়ে আসল সত্য চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল?